বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে আবারও উঠেছে এক পুরনো প্রশ্ন—এই দেশে প্রতিভার মূল্যায়ন হবে, নাকি শুধু পরিচয়ের ভিত্তিতেই সুযোগ মিলবে? আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এবার উপমহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা ও সাংবাদিক এবং আহত “জুলাই যোদ্ধা” গেজেটেডরিয়াজুল রিজু।
“বাপজানের বায়স্কোপ”-এর পরিচালক রিজু এককভাবে তিনটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট মোস্তফা কামাল নান্নু তার ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির মঞ্চে তৎকালীন সরকারপ্রধান নিজ হাতে তাঁকে সম্মাননা দিয়েছিলেন। অথচ সেই একই নির্মাতা যখন নতুন চলচ্চিত্রের জন্য সরকারি অনুদানে আবেদন করেন, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় “বিএনপি-ঘেঁষা” আখ্যা দিয়ে।
প্রশ্ন উঠছে একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী, যিনি কোনো রাজনৈতিক প্রচারে কখনো যুক্ত ছিলেন না, তিনি কীভাবে রাজনৈতিক অনুগ্রহ কিংবা অবজ্ঞার শিকার হন?
সংস্কৃতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং একটি বড় প্রবণতার প্রতিফলন।
রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দিতে গিয়ে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি নিরপেক্ষ থাকেন, তাঁকে সহজেই বিরোধী দলে যুক্ত করে দেখা হয়।
গুণগত মান কম হলেও দলীয় ঘনিষ্ঠ নির্মাতারা নিয়মিত অনুদান পাচ্ছেন। শুধু রিজু নয়, বহু প্রতিভাবান শিল্পী মতাদর্শগত স্বাধীনতার কারণে অবহেলার শিকার হয়েছেন।
সাহসী কণ্ঠগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, শিল্প হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত প্রপাগান্ডা।
২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “বাপজানের বায়স্কোপ” চলচ্চিত্র শুধু একটি সিনেমা ছিল না। এটি ছিল গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য, মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি ও সংকটের নান্দনিক দলিল। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত এই সিনেমার নির্মাতাকে উপেক্ষিত হতে হয় রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। এমন অভিযোগ সংস্কৃতি অঙ্গনে হতাশা তৈরি করেছে।
শিল্পীকে রাষ্ট্রের নৈতিক বিবেক হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ তাঁকে যদি দলীয় আনুগত্যের শর্তে বাঁধা হয়, তাহলে সমাজ সৃজনশীলতা হারায়। অনেকেই মনে করছেন, শিল্প-সাহিত্যে এই দলীয়করণ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আনুগত্যশীল “সেইফ শিল্পী” পাবে, কিন্তু হারাবে স্বাধীন চিন্তার কণ্ঠ।
রিয়াজুল রিজুর ঘটনা শুধু একজন শিল্পীর অপমান নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতির সংকটের ইঙ্গিত। এখন বড় প্রশ্ন— এই সমাজে কি আর সত্য বলার সাহস থাকবে?
প্রতিভার দাম থাকবে, নাকি শুধু পরিচয়ের?
সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই বলছেন, শিল্পকে রাজনীতিমুক্ত রাখা ও অনুদান ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করা এখন সময়ের দাবি। নইলে শিল্পচর্চা সৃজনশীলতার বদলে কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতীক হয়ে পড়বে।
এই বিষয় জানতে চাইলে রিয়াজুল রিজু বাংলা ভয়েস কে বলেন,“আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম না। আমি শুধু নাটক ও সিনেমা বানাতে চাই, শিল্প নিয়েই কাজ করতে চাই। এর বাহিরে আমি একজন সাংবাদিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, শিল্পের মান নয়—শিল্পীর পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠছে। অনুদান চাইলে আমাকে ‘বিএনপি-ঘেঁষা’ তকমা দিয়ে বার বার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু আমার অপমান নয়, বরং পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য অপমানজনক। একজন শিল্পী যদি দলীয় পরিচয়ে বিচার হন, তাহলে নিরপেক্ষ থাকা কি অপরাধ?”
তিনি আরও বলেন, “যতদিন বেঁচে আছি, আমি সত্যের পক্ষেই কথা বলব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পীর আসল দায়িত্ব হলো সমাজের সত্যকে তুলে ধরা। সেই কাজ আমি করে যাবো।”
রিজুর এই মন্তব্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অভিযোগ নয়, বরং শিল্প-সাহিত্যে চলমান দলীয়করণের সমস্যার প্রতিফলন।


















