তিমির বনিক, (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা :
সাবেক এমপি আব্দুল জব্বার বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার আলালপুর গ্রামে ১৯৪৫ সালে (১৭ নভেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোঃ আব্দুল মজিদ এবং মাতা সমিতা বানু।
আব্দুল জব্বার কিশোর বয়স থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৬২ সালে এস.এস.সি পরিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রির্পোট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরি, প্লেকার্ড প্রদর্শন ও সমাবেশ করার কারণে ঐ রাত্রেই গ্রেপ্তার হন এবং তিন মাস কারাবন্দী ছিলেন।
তিনি ১৯৬৬ সালে বিত্তবানদের সহযোগীতায় কুলাউড়া শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন।
১৯৬২-৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সংগঠক, ১৯৬৪-১৯৬৬ সালে কুলাউড়া থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৪-১৯৬৭ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের কার্যকরী সদস্য এবং ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।
১৯৮৪-১৯৯২ সাল পর্যন্ত মৌভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে আজীবন দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৩-১৯৭৭ পযর্ন্ত কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, ১৯৭৮-১৯৮১ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং ১৯৮২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত আজীবন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আজীবন বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধা সংহতি পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ১৯৭২-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত রেড-ক্রীসেন্ট সোসাইটি মৌলীভবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি এবং ১৯৮৬-১৯৯২ পর্যন্ত আজীবন সদস্য ছিলেন।
তিনি ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি কুলাউড়া থানা শাখার আহ্বায়ক ছিলেন।
এ ছাড়া তিনি ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’এর গণঅভ্যূত্থান এবং ৯০’র এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতহিাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষণের পর তিনি হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ওয়ারলেস এ প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্দুল জব্বার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।
পরে ৬ মে পাকবাহিনী কুলাউড়া আক্রমণ করলে তাঁর দুই সহযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগর চলে যান। ধর্মনগর ইয়ুথ রিসিপিশন ক্যাম্প চালু করে তার চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরনার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের সদস্য এবং রিক্রুট ক্যাম্পের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন এবং সেখানে অবস্থানরত জন প্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পরামর্শ ও পরিকল্পনা করেন।
তিনি বাংলাদেশ লিবারেল ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর ৪ নং সেক্টরের অধীনস্থ মৌলভীবাজার সাব-সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ৪ নং সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেন।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের অবিশ্বাস্য দুঃসংবাদ শুনে আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে ১৭ আগস্ট কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এর প্রেক্ষিতে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং এগারো মাস কারাবরণ করেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করলে আবার গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাবরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি মেজর নুর কারাভ্যন্তরে তাঁকে অমানুসিক নির্যাতন করে এবং এক পর্যায়ে হত্যার জন্য নির্জন কক্ষে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ঠিক সেই মুহূর্তে ফেরেস্তার মতো তৎকালীণ সেনা অফিসার প্রয়াত আমিন আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে ওমানের রাষ্ট্রদূত) তাঁকে উদ্ধার করে কুমিল্লা জেলে প্রেরণ করেন।
আব্দুল জব্বার ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক। নিজ এলাকায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন ও পৃষ্টপোষকতা করেছেন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তিনি ১৯৯২ সালে ২৮ আগস্ট মাসে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
একুশে পদক প্রাপ্ত মরহুম আব্দুল জব্বারের জীবনাদর্শ বর্তমান তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।