বছর ঘুরে আবারও এলো ডিসেম্বর বাঙালিজাতির গর্ব, অর্জন, শোক ও চিরঋদ্ধতার মাস। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী হত্যার বেদনা—এই দ্বৈত অনুভূতিতে প্রতিবারের মতো আজও শুরু হলো গৌরবের ডিসেম্বর।
আজ ডিসেম্বরের প্রথম দিন। দেশের আকাশে নেমেছে মৃদুমন্দ শীতের আমেজ। উত্তর দিকের বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে শীতের জানান। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র—রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, সংবাদমাধ্যম ও অন্তর্জালজুড়ে লাল-সবুজের পতাকা দ্যুতিময় হয়ে ওঠার অপেক্ষায় গোটা জাতি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে টানা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ—সবকিছুই চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে ঐতিহাসিক একাত্তরে।
২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। নয় মাসে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কিন্তু বিজয়ের আনন্দের মাঝেই ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় মর্মন্তুদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।
দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। তাই ডিসেম্বর বাঙালির কাছে যেমন উৎসবের, তেমনি গভীর অশ্রুর মাস।
প্রয়াত লেখক যতীন সরকারের ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থে তিনি স্মরণ করেন সেই হৃদয়বিদারক দিনটির কথা। আকাশবাণীর খবরে একের পর এক বুদ্ধিজীবীর মৃত্যুসংবাদ শোনেন তিনি—মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. মোর্তজা এবং পরে জানতে পারেন আনোয়ার পাশার নামও।
অন্যদিকে গবেষক মঈদুল হাসান তাঁর আলোচিত গ্রন্থ “মূলধারা ’৭১”-এ লিখেছেন, ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি ‘অকল্পনীয় গতিময়তা ও শক্তি’ অর্জন করে—যা পাকিস্তান ও ভারতের সামরিক কৌশলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে ছিল। জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণই ছিল সেই শক্তির মূল উৎস।
বিজয়ের মাস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মাসজুড়ে আয়োজন করবে আলোচনা, শোভাযাত্রা, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ ডিসেম্বর পালন করা হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় বিজয় দিবস।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় পুরো ডিসেম্বর জুড়ে চলবে যাত্রাপালার প্রদর্শনী। দেশের বিভিন্ন এলাকার যাত্রাদলের অংশগ্রহণে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হবে এই যাত্রা প্রদর্শনী, যা চলবে ১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।


















