বাংলা ভয়েস ডেস্ক :
সদ্য ঘোষিত সরকারি চলচ্চিত্র অনুদানের প্রক্রিয়াকে ঘিরে সম্প্রতি ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। সামাজিকমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন শোবিজ অঙ্গনের অনেকে। এবার সরকারি অনুদান প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ।
গতকাল শুক্রবার (৪ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংগঠনটি বলে, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, জনগণের করের টাকায় পরিচালিত সরকারি চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়াকে ঘিরে সম্প্রতি ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের অনুদান তালিকা ১ জুলাই, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই চলচ্চিত্র শিল্প এবং জনমহলে ‘তুমুল আলোচনা-সমালোচনা’ শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়া অবশ্যই স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও পক্ষপাতহীন হতে হবে। এটি যেন কেবল পরিচিত মুখদের জন্য নয়, বরং প্রতিভাবান নতুন নির্মাতাদের জন্যও সমানভাবে উন্মুক্ত থাকে আগামী দিনগুলোতেও।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিতর্ক ও উদ্বেগের মূল কারণগুলো তুলে ধরেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ। সেগুলো হলো—
অস্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া
জুরিবোর্ডসহ সকল কমিটিতে আমলাদের আধিক্য বেশি, যার ফলে সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র বোর্ডের সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। মাত্র ২-৩ মিনিটের পিচিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং নম্বর প্রদান বা বাছাইয়ের কোনো লিখিত মানদণ্ড না থাকা– এই বিষয়গুলো প্রক্রিয়াটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
কমিটির সদস্যদের হতাশা
একাধিক কমিটির সদস্য নিজেই সামাজিকমাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করেছেন, যা এই প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টে)
এ বছর চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি কমিটির সদস্যদের অনেকেই অনুদান প্রাপ্ত নির্মাতা বা প্রযোজক। যদিও নীতিমালায় এ বিষয়ক সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই, তারপরও সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯, দুদক আইন-২০০৪, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কমিটির সদস্যদের অনুদান প্রাপ্তি প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ ও দাবি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ—
চূড়ান্ত নম্বর ও শর্টলিস্ট প্রকাশ
শর্টলিস্ট থেকে চূড়ান্ত অনুদানপ্রাপ্তদের নম্বরসহ প্রতিটি ধাপে সকল ধরনের (চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিচারক ও আমলা বিচারক) বিচারকদের প্রদত্ত নম্বর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
আপিলের সুযোগ
প্রযোজক/পরিচালকদের জন্য একটি কাঠামোগত আপিল প্রক্রিয়া রাখতে হবে, যেখানে তারা প্রাপ্ত নম্বর বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাবেন এবং এর জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।
স্বার্থের সংঘাত রোধ
যারা সরকারি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কমিটির (যেমন: সার্চ কমিটি, জুরি, বা অ্যাডভাইজরি বোর্ড) দায়িত্বে থাকবেন, তাঁদের কোনোভাবেই একই অর্থবছরে অনুদানের জন্য আবেদন বা প্রাপ্তির সুযোগ থাকা উচিত নয়। তাদের নিকটজনেরাও ওই একই সময়ে অনুদান প্রাপ্ত হতে পারবেন না বিষয়ক বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
স্পষ্ট নম্বর প্রদানের মানদণ্ড
চূড়ান্ত নম্বরের মানদণ্ড কী ছিল, তা স্পষ্টভাবে জানানো হোক। প্রস্তাবনা, পূর্ব অভিজ্ঞতা, নাকি কেবল কয়েক মিনিটের পিচিং—কোন ভিত্তিতে কাকে কত নম্বর দেওয়া হলো, তা পরিষ্কার করা জরুরি।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কমিটির গঠন
জুরিবোর্ডসহ সকল কমিটিতে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আধিক্য থাকতে হবে।
স্কোর উন্মুক্তকরণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের অনুদানের প্রাপ্ত স্কোর পাবলিকলি উন্মুক্ত করতে হবে।
সবশেষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ বলে, ‘আমরা বিশ্বাস করি, শিল্পের সত্যিকারের উন্নয়ন চাইলে প্রথমেই প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা। আমরা চাই একটি ন্যায়সঙ্গত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া, যা নতুন নির্মাতা, প্রতিভাবান গল্পকার এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চলচ্চিত্রকর্মীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে। স্বার্থবিরোধী অবস্থান নয়, চাই দায়বদ্ধ নেতৃত্ব। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়নে অনুদান প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও ইতিবাচক পদক্ষেপ কামনা করছি।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২টি চলচ্চিত্রকে মোট ১৩ কোটি টাকা সরকারি অনুদান দেওয়ার তালিকা প্রকাশ করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ১২টি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২০টি। তবে প্রতি বছরের মতো এবারও অনুদান কমিটির স্বচ্ছতা ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ উঠেছে যে, যাঁরা অনুদান দেবেন, তাঁরাই এবার নিয়েছেন অনুদান! তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিনেমা নির্মাণের জন্য অনুদানপ্রাপ্ত মো. আবিদ মল্লিক চলচ্চিত্র অনুদান উপ-কমিটির সদস্য।
চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং চলচ্চিত্র অনুদান স্ক্রিপ্ট বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন সাদিয়া খালিদ রীতি। এদিকে, চলচ্চিত্রবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটিতে রয়েছেন মো. আরিফুর রহমান ও মুশফিকুর রহমান। এ ছাড়াও ফিল্ম আর্কাইভ বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য লাবিব নাজমুস ছাকিব এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সংস্কারে সার্চ কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সাইদুল আলম খান।